নাজীম, আমার বন্ধু। সে একটি সরকারী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র। তার জীবনের ভালবাসার অধ্যায়ই আমার অগোছালো লেখার বর্হিপ্রকাশ।
বড় বোনের বিয়ে- ৬ অক্টোবর, ২০০৬ ইং তারিখ। একমাত্র বোন বলে কথা! এই বিয়েতে নাজীমের কর্তৃত অনেক। তাই একমাত্র ভাই হিসেবে ফটোগ্রাফির দায়িত্বটা, শখের বসেই নাজীমের কাঁধে।
বিয়ের দিন কণে হতে শুরু করে, আবাল-বৃদ্ধ সবাই সেজেছে নতুন সাজে। সমস্ত বাড়ির চার পাশের গাছ গুলোতে তিন ফুট পর্যন্ত চুনার আস্তর। এক খুটি হতে আরেক খুঁটি; এভাবে সারি করে সূতলী টানিয়ে লাল, নীল, হলুদ রঙ্গের কাগজ ত্রিকোণাকার কেটে সাজানো হয়েছে উঠানজোড়া। বাঁশ, কাঠ ও কাপড়ের সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছে বর বরণের গেট।
দিনটি ছিলো শুক্রবার। জুমাবাদ বরের আগমন ঘটে। গেটের সম্মূখে টেবিলের উপর কয়েক ধরণের রঙ্গীন শরবত। পাশে কণে পক্ষের তরুণীদের ১০,০০১/- টাকার দর কষাকষি।
কণে পক্ষের তরুণীরা সঠিক দক্ষিণা পাচ্ছে না বিধায় লাল ফিতা কাটতে দিচ্ছেনা বরকে। নাজীম ক্যামেরার ফোকাস দিয়ে ফ্রেম বদ্ধ করছে এসব দৃশ্য গুলিকে।
বরযাত্রী অর্ধ-শতাধিক। এর মধ্যে তিনজন মধ্য বয়স্ক মহিলা এবং পাঁচজন টিনএজ ধরণের মেয়ে রয়েছে। মেয়ে গুলো গাড়ী থেকে নেমেই অন্দরমহলে কণে দেখতে ঢুকলো।
ইতিমধ্যে গেটপাসের দর কষাকষির অবসান হয়েছে। বরের দাদী শ্বাশুরী আংটি পরিয়ে বর বরণ করেছে । নাজীম বন্ধ সুমনকে নিয়ে অন্দরমহলে যায়। ক্যামেরার ফোকাসে ফ্রেমবন্ধি করে তিন কণ্যার প্রতি আকৃতি। পাশ থেকে মেয়ে কন্ঠে বিদ্রোহী আওয়াজ, “ ছেলেরা এখানে কেন?” নাজীম পাল্টা প্রশ্ন করে “আপনারা এখানে কেন?” সহজ উত্তর; “ আমরা বউ দেখতে”
- আমরা এখানে বউ দেখাতে-
- আপনারা কণের কি হন?
- আমরা কণের ভাই, আপনারা বরের কি হন?
- আমরা বরের বোন হই।
সুমন বলে, “তাহলে তো আমরা বেয়াই-বেয়াইন, জমবে ভাল।” একটি মেয়ে এ কথার প্রতিবাদ করে, “Ñ ওঁহ”। নাজীম মেয়েটির দিকে তাকায়। ঘিয়া রঙ্গের সিল্কী লেহেঙ্গা পড়া দুধে আলতা বর্ণ মেয়েটি। বন্ধু হিসেবে মেয়েটির রূপ বা সৌন্দর্যের বর্ণনা, এর বেশি আমি দিতে চাই না।
সুমন, নাজীম কে ধাক্কা দেয়, “কিরে কই গেলি।” নাজীম বাস্তবে ফিরে আসে। (এতক্ষণ হয়তো স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে, কল্পনার কোন রাজ্য পারি দিয়ে এসেছে। সঙ্গে হয়তো মেয়েটিও ছিল।) নাজীম কথা না বাড়িয়ে, চলে আসে অন্ধরমহল থেকে।
এদিকে, বরযাত্রীদের খাবার পরিবেশন শুরু। নাজীমের কাকা, নাজীমকে ডেকে বলে, “ বর পক্ষের মেয়েদের ডাক দাও, ওরা-ও খেয়ে ফেলুক।”
নাজীম মেয়েদেরকে খাওয়া জন্য ডেকে আনে।
খাওয়া শেষে, মেয়েরা আবার অন্দরমহলে যায়। লেহেঙ্গা পড়া মেয়েটি এদিক ওদিক তাকায়। সম্ভাব্য নাজীমকে খুঁজছে মনে মনে। কিন্তু, আশে পাশে নাজীমকে দেখা গেলনা।
কিছুক্ষণ পর নাজীম বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করলে, মেয়েটি ডাক দেয়,
“এই যে বেয়াই” নাজীম তাকায়।
মেয়েটি বলে,
- ক্যামেরা নিয়ে আসেন, আমরা ছবি উঠাবো।
- একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
কণের পাশে, বান্ধবীদেরকে নিয়ে, মেয়েটি বেশ কয়েকটি ছবি উঠায়। ছবি উঠানো শেষে নাজীম বলে,
“ আপনাদের কার নাম কি?”
লেহেঙ্গা পড়া মেয়েটি এক নিঃশ্বাসে- “ আমি রীমা, ওর নাম তানিয়া, ওর নাম কুসুম। আপনার নাম হল নাজীম, আপনার বন্ধুর নাম সুমন।” নাজীম মুচকি হেসে মৃদু কণ্ঠে,
-“ ধন্যবাদ” আপনি রীমা?
- হ্যাঁ, কেন ?
- না এমনিতেই বললাম।
কণে সম্প্রদানের কাজ শেষ। এখন বিদায়ের পালা। যাবার সময় রীমা গাড়ীর ভিতর থেকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়, নাজীমকে। নাজীমও সাড়া দেয়।
সেই রাত্রিতে কনে গৃহ যেন একবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
পরদিন কণের বাড়ি হতে মেহমানগণ দুপুরের আগেই বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে বরগৃহে পৌছায়। রাস্তার পাশেই প্রকান্ড বাড়ি। বাড়ির সামনে ঘাট পাকা পুকুর। অন্য পাশে বিস্তৃর্ণ ফসলে মাঠ। মনোরম পরিবেশ।
নাজীম গাড়ী থেকে নেমেই বরকে কৌশল জিজ্ঞেস করে, বোনকে দেখতে গেলো।
- কিরে, কি অবস্থা ?
- ভাল, তোর কি অবস্থা ?
- এইতো তোকে দেখতে আসলাম।
- শুধু কি আমাকে, নাকি রীমাকেও...?
- মানে ?
- মানে কিছু নাই। এমনিতেই বললাম।
- তোর মানে তুই নিয়ে তাক, আমি বাড়িটা ঘুড়ে দেখি।
নাজীম ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আশে পাশে দেখার পর, পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে। এখানে পরিবেশটা বেশ মুক্ত। এমন সময় পেছন থেকে,
- কেমন আছেন?
- ও আপনি, বসুন। কেমন আছেন? (পিছন ফিরে তাকিয়ে)
- ভাল, কিন্তু, আপনি এমন কেন?
- কেমন?
- আপনি আসলেন, অথচ দেখা করলেন না কেন?
- এই ব্যাপার, এখন তো দেখা হলোই!
- আপনি আমাকে, আপনি বলেন কেন? আমি কি আপনার বড় হই?
- তাতে কোন সমস্যা?
- না। আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।
- ঠিক আছে, বলবো।
- কি?
- কিছু না। তোমার কথা বল।
- কি বলবো?
- তুমি কোন ক্লাসে, কোথায় লেখা-পড়া করো?
- আমি কটিয়াদী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়ি।
নাজীম রিমার সাথে যতই কথা বলছে , ততই এক অজানা ভাললাগা কাজ করছে। রীমা বলে,
- আমাদের আবার কবে দেখা হবে?
- কবে দেখা হবে?
- তিন মাসে পর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে আমি এখানে আসবো। আপনিও আসবেন ।
মাথা রেখে হ্যাঁ সম্মতি জানায় নাজীম। বাড়ির ভেতর থেকে, ওদেরকে ডাকছে নাজীমের বোন জামাই। ওরা বাড়ির ভেতর যায়। নাজীম সেদিন খাওয়া দাওয়া শেষ করে, বিদায় নিয়ে তার বাড়ি চলে এসেছিলো।
বাড়িতে আসার পর রীমাকে বারবার মনে পড়ে, নাজীমের। কিন্তু, কেন? উত্তর জানা নেই । তাই, তিন একমাস না যেতেই, বোনের জামাই বাড়িতে হাজির হয়েছিলো নাজীম। বোনের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলো রীমা কথা। বোনও জানিয়ে দেয় রীমা পরিচয়, “রীমা আমার খালা শাশুড়ির মেয়ে, ওদের বাড়ি অনেক দূর। ওরা বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলো। রীমা বলে গেছে, পরীক্ষার পর আসবে। তুই কি রীমার প্রেমে পড়েছিস?”
- আমি জানি না। কিন্তু ওর কথা বারবার মনে হয়।
- তাহলে তুই শেষ, এসব বয়সের মেয়েরা উরন্ত প্রকৃতির, এদের মানসিকতার পরিবর্তন দ্রুত হয়। এরা ভালবাসা কি বুঝে?” নাজীম কথা বাড়ায় না।
সেদিনই নাজীম বাড়ি চলে আসে। এমন একটি দিন যায় না, রীমার কথা নাজীমের মনে হয়নি। রীমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেনা। তাই দু-মাস পর আবার বোনের বাড়ি যায়। কিন্তু, রীমার দেখা নাই।
তিনমাস, ছয়মাস, একবছর, দু-বছর, তিনবছর, চারবছর যায়। কিন্তু, কোন খবর পায় না।
এক সময় নাজীম ভেবে নিলো, তার মামাতো বোনের কথায় ঠিক। বয়:সন্ধিকালের মেয়েরা কাউকে দেয়া কথা মনে রাখতে পারে না।
পাঁচ বছর পর...
নাজীম, ইউআইএসসিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানটি বাকাশিবো কর্তৃক অনুমোদিত। গত ২০১৩ সালের জানুয়ারীতে এ প্রতিষ্ঠানে রীমার এক মামাতো ভাই কম্পিউটার শিখতে আসে। একদিন কথায় কথায়, ওই রীমার সব তথ্য নাজীমকে দেয় । বর্তমানে রীমা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবে।
একদিন ( রীমার মামাতো ভাই) রুহুলকে নিয়ে নাজীম, রীমাদের বাড়িতে যায়। আশা করেছিলো রীমা হয়তো তাকে দেখে অনেক খুশি হবে। কিন্তু, রীমা নাজীমকে চিনতেই পারেনি। নাজীম অবাক হয়ে তাকায়। কিবা বলার আছে ওর? রুহুল নাজীমকে পরিচয় করিয়েদিলো। নাজীম শুধু বললো, “আপনার মোবাইল নাম্বারটা যদি দিতেন, তাহলে আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।” রীমা অনায়াসেই নাম্বারটা দিয়ে দেয়।
পরদিন....
নাজীম রীমার মোবাইলে একটি মেসেজ দেয়, “....আমি সেই ছেলে।” কিন্তু, কোন উত্তর আসেনা ।
কয়েকদিন পর...
আরো একটি মেসেজ,
“ একমাঠে ধান খেতে এসে পরিচয় হয় পায়রা-পায়রীর।
বিদায় বেলায় পায়রী বলে,
কাল এসো এই মাঠে, দেখা হবে দুজনে। পরদিন পায়রা আসে।
কিন্তু, পায়রী আর আসে না। পায়রী কি অন্য পায়রার পথ ধরেছে?”
নাজীমের মোবাইলে কল আসে। ওপাশ থেকে রীমার,
- আপনি আমাকে এরকম মেসেজ দিলেন কেন?
- এমনিতেই দিলাম। ( অপ্রস্তুত হয়ে )
- এরূপ মেসেজ আর কখনো দিবেন না। আমার সমস্যা হয়।
- ঠিক আছে।
ছয় মাস পর...
নাজীম কলেজ ছাত্রাবাসে থাকে। হঠাৎ একদিন নাজীম মোবাইলে বলে,“ নাজীম ভাই, রীমা হয়তো আপনাকে ফোন দিতে পারে!
পরদিনই রীমা নাজীমকে কল দেয়, এবং একদিন এসে ভর্তি পরীক্ষার ফরম জমা দিয়ে যায়। নাজীম কিছুই বলে না।
পরীক্ষার আগের রাতে, নাজীম রীমাকে ফোন দিয়ে আসন সম্পর্কে জানায়।
পরীক্ষার দিন...
পরীক্ষার পর কলেজ গেটে দেখা হয় দুজনের। নাজীম বলে-
- তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো?
- কি কথা?
- তেমন কিছুনা, যদি শুনো তাহলে বলবো, অন্যথায় তোমাকে গাড়ীতে উঠিয়ে দিব।
- সমস্যা নেই বলুন।
নাজীম বিগত পাঁচ বছরের তিক্ত প্রতিক্ষার কথা রীমাকে জানায়। জানতে চায়, কেন এই অপেক্ষা? একি ভালবাসা নাকি অন্য কিছু? রীমার কোন উত্তর নেই। নাজীম বলে- “ আমি তোমাকে ভালবাসি। বাড়িতে গিয়ে আমার এই কথাগুলো ভেবে দেখো।” রীমা গম্ভীর। নাজীম আর কথা বাড়ায় না, রীমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়।
সাত দিন পর...
নাজীমের মোবাইলে একটি মেসেজ আসে- “ আই লাভ ইউ টু...”
এর কিছুদিন পর তাদেরকে নরসুন্দা নদীর পাড়ে দেখেছি, হাসতে হাসতে বাদাম খাচ্ছে, আর কি যেন বলছে।